বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ |
বাংলা সাহিত্যেরে ইতিহাস হাজার বছরের অধিক কালের ও পুরান। এই দীর্ঘ ইতিহাস এর পিছনে গভীর ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে সংস্কৃত সাহিত্য,ইসলামী সাহিত্য ও ইংরেজি সাহিত্য। তাছাড়া বিশ্বের অন্যান্য সাহিত্যের প্রভাব এসেছে ইংরেজি সাহিত্যের মাধ্যমে । এর প্রভাবের কারণে সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে। বাংলা সাহিত্যের স্বকীয় মূর্তি লাভের শুভ মূহুর্তে সংস্কৃতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব যেমন প্রবল ছিল তেমনি পরবর্তীকালে এ সাহিত্যের বিকাশে আরবি, ফারসি, ইংরেজি সাহিত্যের ভূমিকা ও বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। যুগে যুগে এদেশে সংস্কৃতি ও বাঙালিত্ব ক্রমবিবর্তিত। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও আন্তর ভাব ও বহিরঙ্গ অভাবের পরিবর্তন এসেছে। জীবনের মূলীভূত ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ বিষয়ক নানা বিবর্তনের বৈচিত্রের সৃষ্টি হয়েছে। এই বৈচিত্র সরাসরি সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে। বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগের পেছনে সময়ের বৈচিত্র কাজ করেছে।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন চর্যাপদের সূচনা থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে সাধারণভাবে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক এই তিন যুগে ভাগ করা হয়েছে।কিন্তু চর্যাপদের প্রথম রচনা কাল সম্পর্কেও পণ্ডিতেরা ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেন নি। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে চর্যাপদের রচনাকাল ৬৫০ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে। অপরপক্ষে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ৯৫০ থেকে ১২০০ । উৎপত্তি কাজ সম্পর্কে মতানৈক্য থাকলেও এর পরবর্তী বিকাশের সমৃদ্ধ ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তির কোন অবকাশ নেই। মধ্যযুগ ১২০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত এবং আধুনিক যুগ ১৮০০থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। কারও কারও মতে ১২০০ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত এই দেড়শ বছর "অন্ধকার যুগ"। আধুনিক যুগকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে । ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত আধুনিক যুগের প্রথম পর্যায় এবং ১৮৬০ থেকে বর্তমান সময় কাল পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্যায়।
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ বা আদি যুগের নিদর্শন চর্যাপদ । এই চর্যাপদের রচনা কালের সময়ের উপর নির্ভর করে প্রাচীন যুগের সময়সিমা নির্দারন করা হয়েছে ।চর্যাপদের সময়সিমা সম্পর্কে ড.ক্ষেত্র গুপ্ত বলেন :-
“বাংলা ভাষায় প্রথম কবিতা সংকলন চর্যাপদ নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে সহড়জিয়া বৌদ্ধদের এই সাধন সঙ্গীত গুলি রচিত হয়। এর ভাষা যে হাজার বছর আগের প্রাচীন বাংলার পন্ডিতেরা প্রমান করেছেন ।’’১
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক নেপালের রাজগ্রন্থশালা থেকে ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সাহায্যে ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘হাজার বছরের পুরান বাংলা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’নামক গ্রন্থের চব্বিশ জন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যের রচিত চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের সাতচল্লিশটি গান চর্যাপদ নামে পরিচিত।
মধ্যযুগ ১২০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত সম্প্রসারিত। অনেকে ১২০০ থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত সময়কে যুগসন্ধি বা অন্ধকার যুগ বলে অবহিত করেন থাকনে। এই সময়ে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে বলে তেমন প্রমাণ মিলে না। তবে এ সময়ে বাংলা সাহিত্যের বাইরে উল্লেখযোগ্য অন্যান্য সাহিত্য সৃষ্টির নিদর্শন বর্তমান থেকে এ অন্ধকার যুগের অপবাদের অসারতা প্রমান করেছে।
মধ্যযুগের প্রথম নিদর্শন বড়ু চন্ডীদাসের ''শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন'' কাব্য। আনুমানিক চৌদ্দ শতকের শেষার্ধে বা পনের শতকের প্রথমার্ধে কবি বড়ু চন্ডীদাস রাধা কৃষ্ণের প্রেমকাহিনি অবলম্বনে এ কাব্য রচনা করেন। মৈথিলী কবি বিদ্যাপতি ব্রজবুলি ভাষায় রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিষয়ক পদ রচনা করেন। মধ্যযুগের রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান কাব্য ধারায় মুসলমান কবিদের অবদান অনস্বীকার্য। মধ্য যুগের প্রথম মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের "ইউসুফ-জোলেখা" কাব্যের মাধ্যমে এধারার শুরু হয়। মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্য দেবের আবির্ভাবের ফলে বাংলা সাহিত্যে তাকে কেন্দ্র করে জীবনী সাহিত্য শুরু হয়। তার জীবনি নিয়ে রচিত হয় বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভগবত, লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল, কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতান্য চরিতামৃত প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বৈষ্ণব পদাবলী, অনুবাদ সাহিত্য এবং বাংলার বাইরে আরাকান রাজ সভায় ও সাহিত্য চর্চা শুরু হয়েছিল মধ্য যুগ থেকে। তাই ১২০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ কাল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল।
১৮০০ সাল থেকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের শুরু। এ সময়ে দেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনের ফলে শিক্ষিত বাঙালি ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রভাব প্রতিফলিত হতে থাকে। আধুনিক যুগের প্রথম পর্যায়ে বাংলা গদ্যের চর্চা শুরু হয় এবং সাহিত্যের ভাষা হিসেবে গদ্য পরিণিতপর্যায়ে উন্নীত হয়। তার ফলে বাংলা সাহিত্যে আধুনিক সাহিত্য শাখা প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস নাটক সৃষ্টি হয়ে বাংলা সাহিত্যকে বৈচিত্র্যমুখী করে তোলে।
বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাগ সম্পর্কে পণ্ডিতেরা ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের শাসক ও ধর্ম মতের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে কেউ কেউ যুগবিভাগ করেছেন বলে এই মতানৈক্য প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রাচীন ও আধুনিক কালের বাংলা সাহিত্যের প্রথম ইতিহাস “রামগতি ন্যায়রত্ন” রচনা করলে ও বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতিতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রথম রচনা করেন ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন।এ প্রসঙ্গে শ্রী পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন:-
“ রামগতি ন্যায়রত্ন ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ গ্রন্থে বাঙলা সাহিত্য আলোচনার গোড়াপত্তন করলেও অপেক্ষাকৃত বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সর্বপ্রথম রচনা করেন ড. দীনেশচন্দ্র সেন।”২
রামগতি ন্যায়রত্ন তার গ্রন্থে ইতিহাসের তিনটি অংশ নিয়ে আলোচনা করেছেন:-
১।আদ্যকাল অর্থাৎ প্রাক-চৈতন্য পর্ব এই অংশে বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, কৃত্তিবাসের আলোচনা আছে।
২।মধ্যকাল অর্থাৎ চৈতন্য থেকে ভারতচন্দ্রের পূর্ব পর্যন্ত।
৩। ইদানীন্তন কাল - ভারতচন্দ্র থেকে রামগতি ন্যায়রত্নের সমকালিন কবি সাহিত্যিকদের বিবরন রয়েছে।
“বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’’ গ্রন্থে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত ইতিহাস তুলে ধরেছেন এবং সেখানে বিভিন্ন সাহিত্য সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য পর্যলোচনা করে বাংলা সাহিত্যকে কয়েকটি যুগে ভাগ করেন: -
ক. হিন্দু- বৌদ্ধ যুগ(৮০০ থেকে ১২০০সাল)।
খ.গৌড়ীয় যুগ বা শ্রীচৈতন্য পূর্ব যুগ।
গ. শ্রীচৈতন্য সাহিত্য বা নবদ্বীপের প্রথম যুগ।
ঘ. সংস্কার যুগ।
ঙ.কৃষ্ণচন্দ্রীয় যুগ অথবা নবদ্বীপের দ্বিতীয় যুগ।
ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনের সামনে তথ্যের অভাব ও গবেষণার অপূর্ণতা বিদ্যমান ছিল বলে তিনি যুগ লক্ষণ সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারেননি। প্রাচীন যুগকে তিনি যে অর্থে হিন্দু-বৌদ্ধ যুগ বলে চিহ্নিত করেছেন তা একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ দিয়ে প্রমাণিত হয় না। কোন সঠিক সূত্র তিনি প্রয়োগ করে যুগ বিভাগ করেননি। কোথাও ধর্ম, কোথাও শাসক তার যুগ বিভাগের আদর্শ হয়েছে বলে তা সুষ্ঠ হতে পারেনি।তাই শ্রী পরেশচন্দ্র বলেছেন:-
"যখন বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং সম্পর্কে আলোচনা অনেক দর অগ্রসর হয়েছে এবং অনুসন্ধান ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষনের ফলে বহু নতুন তথ্যও আবিষ্কৃত হয়েছে তখন দীনবেশ বাবুর প্রাচীন অনৈতিহাসিক অভিমত বর্জন করাই বিধেয়।" ৩
ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ে বাংলা সাহিত্যের যে যুগবিভাগ করেছেন তাহল:-
ক. প্রাচীন যুগ বা মুসলমান পূর্ব যুগ( ৯৫০-১২০০)
খ.তুর্কি বিজয়ের যুগ(১২০০-১৩৫০)
গ.আদি মধ্যযুগ বা প্রাক চৈতন্য যুগ (১৩৫০-১৫০০)
ঘ.অন্ত্য মধ্যযুগ(১৫০০-১৮০০)চৈতন্য ও নবাবি আমল
ঙ. আধুনিক বা ইংরেজীযুগ(১৮০০সাল থেকে বর্তমান)
উপরুক্ত যুগবিভাগটি সম্পূর্ণ ত্রুটি মুক্ত নয়। কারণ কখনো ধর্ম, কখনো শাসন আমলের উপর ভিত্তি করে যুগ বিভাজন করা হয়েছে একক কোন ধারা বজায় রাখে নি।
ডঃ আহমদ শরীফ সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে চারটি যুগে বিভক্ত করেছেন:-
১. মৌর্য গুপ্ত পাল সেন শাসনকাল-প্রাচীন যুগ।
২.তুর্কি-আফগান-মোগল-শাসন কাল-মধ্যযুগ।
ক.আদি মধ্যযুগ তের চৌদ্দ শতক।
খ.মধ্যযুগ-পনের-আঠার শতক।
৩.ব্রিটিশ শাসন কাল-আধুনিক যুগ।
৪. স্বাধীনতা উত্তর কাল বর্তমান যুগ
ডঃ শহিদুল্লাহ মধ্যযুগকে ভাগ করেছেন:-
ক. পাঠান আমাল (১২০০থেকে ১৫১৭)
খ.মুঘল আমল (১৫৭৫-১৮০০)
অন্যদিকে ড.অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্যযুগকে ৪টি ভাগে ভাগ করেন।
ক. প্রথম পর্ব:প্রাক চৈতন্য যুগ চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতক
খ.দ্বিতীয় পর্ব:চৈতন্য যুগ ষোড়শ শতাব্দী
গ.তৃতীয় পর্ব :উত্তর চৈতন্য যুগ-সপ্তদশ শতাব্দী
ঘ.চতুর্থ পর্ব: অষ্টাদশ শতাব্দী
এমনিভাবে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের বিভাগ সম্পর্কে বিভিন্ন মতের প্রকাশ ঘটেছে। এসব মতপার্থক্য দূর করার জন্যই কেউ কেউ মধ্যযুগকে আদি মধ্যযুগ (১২০০-১৫০০) এবং অন্তমধ্যযুগ(১৫০০-১৮০০) এই দুই পর্যায়ে ভাগ করেন।এ সম্পর্কে ড.ওয়াকিল আহমদ বলেন:-
"ড. দীনেশচন্দ্র সেন ও ড. আহমদ শরীফের আন্তঃ যুগ বিভাগ কিছু যৌক্তিকতা আছে।কিন্তু ডক্টর সুকুমার সেন ও ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভাজনটি সরলরৈখিক। " ৪
উপবিভাগ গুলো নিয়ে মত বিরোধ থাকলেও আধুনিক যুগ নিয়ে মত বিরোধ নেই। সকল গবেষকদের গবেষণা নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করার পর তিনটি যুগ অর্থাৎ প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগ এভাবেই পর্যায়গুল বিভক্ত করা যায়। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন নিদর্শন পর্যালোচনা করলেও এই তিনটি পর্যায় উঠে আসে। তাই বিভিন্ন যুগের লক্ষণের দিক থেকে সময়ের ব্যবধান থাকলেও তা সমন্বয় করে একটি নির্দিষ্ট সময় ভিত্তি করে বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ নির্দেশিত হয়েছে।
তথ্য সূত্র তালিকা
১।ড. ক্ষেত্র গুপ্ত, বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস, পৃ.৪৬।
২।শ্রী পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের পরিচয় ১ম খন্ড, পৃ.১৪।
৩। ঐ পৃ.১৬।
৪। ড.ওয়াকিল আহমদ,বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত, পৃ.১০।
Comments
Post a Comment