মধ্যযুগের অন্যতম সাহিত্যসৃষ্টি রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান। প্রণয়োপখ্যান এর মূল রূপকার ছিলেন মুসলিম কবি গান। প্রেম ও সৌন্দর্য সৃষ্টি এ ধারার প্রধান লক্ষ্য ছিল। এগুলোতে মানবের হৃদয়বৃত্তি, চিত্তবিলাস ও সম্ভোগের যে লীলা প্রকাশিত হয়েছে তাতে সে যুগের শিল্প কর্মের ধারায় নতুন রস ও আনন্দ সঞ্চারিত হয়েছে। হিন্দু কবিদের আখ্যানমূলক কাব্যে লৌকিক জীবনের ছায়াপথ থাকলেও তাতে দেবদেবীর মাহাত্ম্য ও পূজারতী প্রাধান্য পেয়েছে। অধিকাংশ মানব চরিত্র, দেবচরিত্র দ্বারা প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। চাঁদ সওদাগরের মতো ব্যক্তিত্ব দেবতার প্রভাব এড়াতে পারেনি। প্রণয়োপখ্যান এর পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, লৌকিক, রাজা-রাজার বিচিত্র কাহিনী যেগুলির প্রধান আবেদন হলো মানব প্রেম।
ইউসুফ-জুলেখা, লাইলী-মজনু, হানিফ-কয়রাপরী, ছয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামান, সতীময়না-লোরচন্দ্রানী, পদ্মাবতী, গুলেবকাওলী প্রভৃতি কাব্যে ধর্ম নেই জীবন আছে। সুখ-দুঃখ, বিরহ-মিলনপূর্ণ মানব জীবনের কথা লৌকক ও অলৌকিক উপাদানের সাথে মিশ্রিত হয়ে আনন্দরসের নতুন ভুবন রচনা করেছে।
কাব্যের নাম থেকেই বোঝা যায় বিষয়বস্তু মৌলিক নয়; মধ্যযুগের কবিরা মৌলিক বিষয়ের সন্ধান পাননি অবিকশিত ব্যক্তিত্বও ব্যক্তি স্বতন্ত্র্যের অভাবের কারণে। লোকোকাহিনী, পুরাণকাহিনী অনুসৃত হওয়ায় সেগুলির কাল্পনিক অলৌকিক উপাদান মানব জীবনকে লঘু রসে সিক্ত করেছে।লঘু-গুরু, বাস্তব-অবাস্তব, মানবিক-দানবিক মিশ্রভাবের এসব রচনাকে কেউ "রোমান্টিক প্রেমকাব্য" কেউ "রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান" বা "রোমান্স কাব্য" বলেছেন।
রোমান্টিক কাব্যের রচনাকালের পরিধি মধ্যযুগ ধরেই। মধ্যযুগের বাংলা রচনার নিদর্শন পাওয়া যায় চৌদ্দ শতক থেকে। ঐ শতকের শেষ দিকে অথবা পনের শতকের গোড়াতে ইউসুফ জোলেখা কাব্যের দ্বারা এ ধারার প্রথম দ্বার উন্মোচিত হয়। অঠারো শতক পর্যন্ত এ ধারার রচনা অব্যাহত থাকে। রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের কাব্য গুলোর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা রচনার কাল সহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:-
প্রণয়কাব্য গুলোর উপাদানের বৈশিষ্ট্য সন্ধান করলে দেখা যাবে যে এই উপাদান বাঙালির ঘরের নয় তা বাইরে থেকে সংগ্রহ করে বাংলা কাব্যে রূপাদান করা হয়েছে। হিন্দি ভাষায় রচিত ভারতীয় কাহিনী এবং আরবি ফারসি ভাষায় রচিত আরবি ইরানি কাহিনী অনূদিত হয়ে নতুন রূপে পরিগ্রহ করেছে। ইউসুফ-জুলেখা, লায়লী-মজনু, হানিফা-কয়রাপরী, সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামাল,প্রভৃতি কাব্যের কাহিনী ফারসি গ্রন্থ থেকে এবং গুলে-বকাওলি, লোরচন্দ্রানী, পদ্মাবতী, মধুমালতী পূর্ববর্তী হিন্দি আবধি গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত হয়েছে।
কবিগণ এসব কাব্যে মানবপ্রেমের জয়গান করেছেন। মানব-মানবীর হৃদয়ের সুখ-দুখঃ আনন্দ-বেদনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। মূল কাব্যের লক্ষ্য অনেক ক্ষেত্রেই আধ্যাত্মিক প্রেম হলেও বাংলা ভাষায় পরিবেশনকালে তা আধ্যাত্মিকতা থেকে মুক্তি পেয়েছে। তাতে মানবপ্রেমের বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়েছে। এই সকল কাব্য গুলোতে মানবপ্রেমের জয় ঘোষণা করতে গিয়ে কবিগণ নর-নারীর দেহগত প্রেমের কথাই বেশি বলেছেন। বাস্তব জীবনের সঙ্গে এই সংযোগ থাকার ফলেই প্রণয়কাব্য গুলোর আবেদন হৃদয়গ্রাহী।
বাংলা রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান গুলোর একটি অংশ আরাকান রাজসভার কবি গানের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে।কবি দৌলত কাজী, কোরেশী মাগন ঠাকুর ও আলাওলের মত প্রভাবশালী কবি আরাকান রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় রোমান্টিক কাব্য রচনা করেছিলেন। দৌলত কাজীর সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী, কোরেশী মাগন ঠাকুরের চন্দ্রাবত, আলাওলের পদ্মাবতী ও সাইফুল মুলক বদিউজ্জামাল বাংলা সাহিত্যের রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যানের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য কাব্য।
ইউসুফ জুলেখা কাব্য রচনার মধ্য দিয়ে এই ধারার শুরু। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলমান কবি হিসেবে শাহ মুহাম্মদ সগীর বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। তিনি গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে ইউসুফ জুলেখা কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি ১৫ শতকে প্রথম দশকে রচিত বলে মনে করা হয়। বাইবেল ও কুরআনের নৈতিক উপাখ্যান হিসেবে সংক্ষেপে এই কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ইরানের মহাকবি ফেরদৌসীর কাব্যের রোমান্টিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে শাহ মুহম্মদ সগীরের কাব্যের যথেষ্ট মিল বিদ্যমান। ইরানের আধ্যাত্মিক কাব্য ও ভারতের লোক-কাহিনীর মিশ্রণে ইউসুফ জুলেখা কাব্যের পূর্ণাঙ্গ কাহিনি নির্মাণ করেন।
Comments
Post a Comment