'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসের অঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ(১৯১৪-১৯১৫) ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে মাইল তিনেক দূরে তিতাস তীরের গোকর্ণ গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। গোকর্ণ গ্রামেই কেটেছে তার শৈশব-কৈশোর জীবন। গোকর্ণ গ্রাম ছিল মালোপাড়া। নানামাত্রিক সামাজিক অবজ্ঞা আর উদাসীনতায় কেটেছে অদ্বৈতের শৈশব জীবন। তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি তাঁর সাহিত্যিক জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা। এই উপন্যাসে আশৈশব-অর্জিত অভিজ্ঞতার বাণীরূপ দিয়েছেন। যে জীবন পরিবেশে তিনি লালিত-পালিত ও বর্ধিত হয়েছেন, সে জীবনকে তিনি এই উপন্যাসের বিশাল ক্যানভাসে অঙ্কন করেছেন।
       অদ্বৈত মল্লবর্মণের "তিতাস একটি নদীর নাম" বাংলাদেশের আঞ্চলিক উপন্যাস সাহিত্যে একটি অনবদ্য ও যুগান্তকারী সৃষ্টি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত তিতাস তীরবর্তী অঞ্চলের দরিদ্র অভাবগ্রস্ত সংগ্রামশীল, পরিশ্রমজীবি, ধীবর সম্প্রদায়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা, হতাশা- বেদনা, শ্রম- বিশ্রাম সংকীর্ণতা -ঔদার্য লেখক শিল্পরূপ দিয়েছেন এই উপন্যাসে।
       আঞ্চলিক উপন্যাসের গুরুত্ব আরোপিত হয় একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের পরিবেশ-প্রতিবেশ, সমাজ প্রকৃতি, আচার-আচরণ উচ্চারণ এবং প্রথা-পদ্ধতির উপর। কেবল একটি বিশেষ জনজীবনের স্থানিক বর্ণিমাই নয় বরং সে জীবনের চিন্তাধারা বোধ-বোধি এবং পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কিভাবে জীবনকে প্রভাবিত সমৃদ্ধ ও সম্পূর্ণ করে তাও আঞ্চলিক উপন্যাসের বিবেচিত বিষয়। তাই বলা যায়, আঞ্চলিক উপন্যাস হচ্ছে একটি অজ্ঞাত, কৌতূহলোদ্দীপক জনজীবনের অন্তরঙ্গ রূপায়ণ। বাংলা সাহিত্যে আঞ্চলিক উপন্যাস বিষয়ক ধারণাটি সুপ্রতিষ্ঠিত। ডক্টর শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন:-
‍‍‍‍     
‍‍‍‍‍‍‍‍‍          "এই জাতীয় উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য হলো ‌‍‍অপরিচত
          রহস্যমণ্ডিত সুদূর ভৌগোলিক  ‌‍‍ব্যবধানে   অবস্থিত কোন            অঞ্চলের বিশিষ্ট ‍‍জনপ্রকৃতি, সামাজিক রীতিনীতি ও                 ধর্মবিশ্বাস ‍‍সংস্কারের  ব্যাপক চিত্রাঙ্কন,অথবা কোন বিশেষ ‍‍         ধরনের বৃত্তিজীবি গোষ্ঠীর জীবনবোধের ‍‍পরিস্ফুটন।”                                                    [বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা                                                       ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍                                              পৃষ্ঠা ৭৬৩]
একটি বিশেষ ভৌগোলিক সীমা-পরিসর অন্তর্গত মানব সম্প্রদায়ের আচার-আচরণ, শিষ্টাচার-লোকাচার, বিশ্বাস-সংস্কারের যথাযথ রুপায়ণ ঘঠেছে "তিতাস একটি নদীর নাম" উপন্যাসে।
      উপন্যাসের প্রথম খন্ডের 'তিতাস একটি নদীর নাম' ‌‌অধ্যায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাসের রং- রেখা স্বভাব দার্শনিকতা মন্ডিত করে পরিবেশন করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিতাস তীরবর্তী মালোপাড়ার একটি সুন্দর ও সুস্পষ্ট ভৌগোলিক পরিচয় দিয়েছেন। আঞ্চলিকতা তুলেধরতে হলে একটি ভৌগোলিক পরিচয় দরকার হয় আর সেটি ঔপন্যাসিক তিতাসের বর্ণনার মধ্য দিয়ে দিয়েছেন।
‍‍‍‍ ভৌগলিক পরিচয়ের পাশাপাশি ওই ভৌগোলিক সিমা-রেখার মধ্যে মানুষের জীবন ধারণ অবস্থা অবস্থান, ঘর গেরস্থালির স্বরূপ তুলে ধরা আঞ্চলিক উপন্যাসের অপরিহার্য বিষয়। উপন্যাসের 'প্রবাস' খন্ডের শুরুতে মালোপাড়ার গেরস্থলীর চিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে :
           “তিতাস নদীর তীরে মালোদের বাস। ঘাটে ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‍‍‍‍বাঁধা নৌকা,                মাটিতে ছড়ানো জাল, ‍‍‍‍উঠানের কোণে গাবের মটকি,                  ঘরে ঘরে ‍‍‍‍চরকি টেকো তাকলি সূতা কাটার, জাল ‍‍‍‍                      বোনার সরঞ্জাম। এইসব নিয়াই মালোদের ‍‍‍‍‌সংসার।”                  ‍ ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌                                                  (তি. এ. ন. না. ১৪)
‍‍      আমরা উপন্যাসে দেখতে পাই তিতাস নদী তীরবর্তী মালো সম্প্রদায়ের একটি পূজাব্রতকে। এই পূজাব্রতের নাম মাঘমন্ডলের ব্রত। এই ব্রতের স্থায়িত্বকাল সারা মাঘ মাস। এ মাসে কুমারী কন্যারা প্রার্থিত বরের আকাঙ্ক্ষায় এই পূজা করে। এই মাঘমন্ডলের ব্রত তাদের লোকবিশ্বাসের চিত্র। এই মাঘমন্ডলের ব্রতকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় ঘটনাংশের  শুরু হয়েছে। শুকদেব পুরের উজানিনগরের খলায় মৎস্য শিকারের যে বর্ণনা অদ্বৈত মল্লবর্মণ এই উপন্যাসে দিয়েছেন তা কৌতূহলোদ্দীপক।  এ বর্ণনায় ধীবর সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস ও সংস্কার মূর্ত হয়ে উঠেছে। শুকদেবপুরের এই খলায় প্রতি বছর দূর অঞ্চলের গ্রাম থেকে অনেক মালো পরিবার এসে  ভিড় জমায়। প্রায় ছয় মাস ভিড় অব্যাহত থাকে। এই খলা বাওয়া মালোদের একটি উৎসবের মতো।
‍‍         মালোপাড়ায় নতুন করে কেউ বসতি করলে তাকে সমাজ ভাগ করে দেয়া হয় এর জন্য দশজনের সভা করা হয়। অনন্তর মাকে নিয়েও এই সভা করা হয় যা সামাজিক রীতিনীতির অংশ। ধর্মীয় উৎসবগুলো ও তাদের লোকাচারের  পাশাপাশি পালন করে আসছে। কালি পূজার সময় কালি পূজা। শ্রাবণ মাসের শেষ দিন মালোদের ঘরে ঘরে মনসা পূজা হয়।  তিতাস পাড়ের মানুষের সাথে নৌকা বাইচের রয়েছে আত্মিক সংযোগ।
       আঞ্চলিক উপন্যাসের আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বর্ণিত জনপদের নিজস্ব ভাষা।লেখক মালোদের আঞ্চলিক ভাষার শব্দের ব্যবহার করেছেন এই উপন্যাসে।যেমন :-
               ‌‍‍"ডোল, খেউ, চরকি, টেকো, তকলি, চৌয়ারি, ‍‍                            কাইজ্যা, ডহর, বুলানি,চোকা প্রভৃতি শব্দ।"
এছাড়া তিনি ব্যবহার করছেন অনেক প্রবাদ-প্রবচন; যেগুলো তিতাস তীরবর্তী মানুষের মনোভাব বিশ্বাস সংস্কার উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতারই দীপ্ত উদ্বোধক।

‍‍‍ বাংলা সাহিত্যে কোন একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস এর সংখ্যা কম নয়। আর সেই ধারায় অদ্বৈত মল্লবর্মণের 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিতাস নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা একদল জেলে সম্প্রদায়ের জীবন নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন ঔপন্যাসিক।মালোদের জীবনের এক সামগ্রিক চালচিত্রই তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাসে।  প্রতিটি মালো নরনারী ব্যক্তিগত জীবন, তাদের গোষ্ঠী জীবনের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এবং তিতাসের উপর নির্ভরশীল মালোদের জীবন-জীবিকার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিচয় ধরা পরেছে এই উপন্যাসটিতে। তিতাস বিধৌত জনপদের স্থানিক বর্ণিমার সঙ্গে সে অঞ্চলের মানুষের জীবন যাত্রার বিশ্বস্ত রূপায়ণসূত্রে এই উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।

Comments