'হাজার চুরাশির মা' মহাশ্বেতা দেবীর একটি কালজয়ী উপন্যাস। এই উপন্যাসের মূল বিষয় তৎকালীন ভারতবর্ষের নকশাল আন্দোলন। 'হাজার চুরাশির মা' উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। ষাটের দশক বা মুক্তির দশকে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। মূলত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি গ্রামের কৃষকদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন শুরু হয়। পরবর্তীতে এই আন্দোলনে যোগদান কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা। কমিউনিস্ট নেতা চারু মজুমদারের নেতৃত্বে হাজার হাজার শিক্ষিত যুবক যুবতি আন্দোলনে যোগ দিয়ে ছিল। যা তৎকালীন সরকার নির্মমভাবে দমন করেছিল। এই প্রেক্ষাপটে 'হাজার চুরাশির মা' উপন্যাসের রচনা করেন প্রক্ষাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী।
'হাজার চুরাশির মা' উপন্যাসের কাহিনী মূলত ব্রতী কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এই উপন্যাসের মধ্যে রূপক অর্থে লুকিয়ে আছে মহাশ্বেতা দেবীর নিজ সন্তান নবারুণ ভট্টাচার্য। ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতির একটি দিক আমরা সবসময় লক্ষকরি যে বিপরীত বিশ্বাসকে কঠিনভাবে দমন করা। 'হাজার চুরাশির মা' উপন্যাসে সেইদিকটি স্পষ্ট। এই উপন্যাসে ব্রতী কোন বিপ্লবী হয়ে উঠল তা খুঁজে বেড়িয়েছেন সুজতা। ষাটের দশকে বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস! নির্বাচন বুর্জোয়াদের ধোঁকাবাজি! পার্লামেন্টে শুয়োরের খোঁয়াড়! প্রভৃতি শ্লোগানে ও ইশতিহারে গোটা পশ্চিমবঙ্গ ছেয়ে যায়। তারপরে অনেক তরুণ-তরুণী নকশাল আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ত করে এবং জীবনের বিনিময়ে হলে ও একটি শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়।
চীন ও রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারা অনুপ্রাণীত হয়ে ভারতের সমাজতান্ত্রিক নেতারা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছেন। রাজনৈতিক দিক দিয়ে পুঁজিবাদী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গোড় বিরোধী ব্রতীরা। ব্রতীর বাবা দিব্যনাথ চ্যাটার্জী এই উপন্যাসে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতিক। ব্রতীরা পুঁজিবাদীদের শ্রেণি শত্রু হিসেবে দেখতেন। তাই ব্রতী তার বাবাকে সহ্য করতে পারতেন না।ব্রতী বলেন :-
" উনি যেসব বস্তুতে ও মূল্যে বিশ্বাস করেন, সেগুলোতেও অন্য বহুজনও বিশ্বাস করে। এই মূল্যবোধ যারা লালন করছে সেই শ্রেণিটাই আমার শত্রু। উনি সেই শ্রেণির একজন।"
[হাজার চুরাশির মা পৃ-১৯]
ব্রতী চরিত্রটি মুক্তির দশকে নিহত তরুণ বিপ্লবীদের প্রতিক। তারা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য পুঁজিবাদী শ্রেণি শত্রুদের হত্যার ঘোষণা দেন। ব্রতীরা পুঁজিবাদী নির্মূল করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন কিন্তু পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামো তাদেরকে সন্ত্রাসী ঘোষণা দিয়েছিল। এর ফলে ব্রতীর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্মম নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। সমাজপতিদের চোখে তাদের বাঁচার অধিকার ছিলনা। দিব্যনাথ সুজাতাকে বুঝিয়ে ছিলেন এ সমাজে বড় বড় হত্যাকারী যারা খাবারে ঔষধে শিশু খাদ্যে ভেজাল মেলায় তারা বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু ব্রতী তাদের চেয়ে বড় অপরাধী কেননা সে এই মুনাফাখোর ব্যবসায়ী ও স্বার্থ নেতাদের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ছিল। তার শাস্তি নিশ্চিত মৃত্যু।
দিব্যনাথ পুঁজিবাদী শ্রেণীর প্রতিনিধি তার সমাজে একটা স্ট্যাটাস আছে। ব্রতীর জন্য তা নষ্ট করতে চায়নি। তাই তিনি ব্রতীর নির্মম মৃত্যুর খবর যেন পত্রিকায় না আসে তার জন্য অনেক চেষ্টা করে এবং সফল ও হন।দিব্যনাথ বাড়ির গাড়ি পর্যন্ত নিতে দেয়নি। উপন্যাসিক বলেন :-
"সত্যি বলতে কি তাঁর ছেলে এমন কলঙ্কিত ভাবে মরেছে এই খবরটা ঢাকার জন্য জ্যোতির বাবা দড়ি টানাটানি করে বেড়াচ্ছিলেন।"
পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যখন বৈষম্য, দুর্নীতি, কালোবাজারি, মজুতদারীর মতো অন্যায়কে নৈতিকভাবে সমর্থন করে, যখন পুঁজিবাদের বিকৃত যৌনাচার ঘাটে ভদ্রতার আড়ালে। তখন ব্রতীর মতো হাজারো বিপ্লবীর আগমন ঘটে। তারা সমাজকে এ সকল অন্যায় ও বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রামের ডাক দেন। পুঁজিবাদীরা এই সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামকে গণতন্ত্রের দেহে ক্যান্সার হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
সুজাতার মাধ্যমে লেখিকা কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন এই সমাজকে। যেখানে একটি অসাধু ব্যবসায়ী একটি দুর্নীতিগ্রস্ত নেতার সম্মানে বেঁচে থাকার অধিকার আছে কিন্তু সমাজ ব্যবস্থার উপর বিশ্বাস হারানো বিশ্বাসে দীক্ষিত তরুণদের বাঁচার অধিকার পর্যন্ত নেই। তিনি এই সেই সময়কার কপট বুদ্ধিজীবীদের আচারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।যারা ওপার বাংলার( বাংলাদেশ) পৈচাশিকতায় উপদ্রুত হয়ে মিছিল বের করতে পারে কিন্তু নিজের শহরে ঘটা পুলিশের নিষ্ঠুর পৈচাশিক চারণ সহজেই উপেক্ষা করতে পারে।
হাজার চুরাশির মা উপন্যাসে মহাশ্বেতা দেবী পাঠকদের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন। ব্রতীদের মত ছেলেদের হত্যা করলেই কি আদর্শের গলাটিপে রুদ্ধ করা যায় না। ছাইয়ে তলায় চাপা আগুন এর মত এই বিশ্বাস ধিক ধিক করে থাকে একদিন আবার জ্বলে ওঠার অপেক্ষায়।
Comments
Post a Comment