বাংলা নাটকের ইতিহাস: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

 

         নাটক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা; এটি মিশ্র শিল্প। নাটক এর  ইংরেজি প্রতিশব্দ  শব্দ Drama যা গ্রিক শব্দ থেকে আগত। বাংলা নাটক অধুনিক কালের ফসল।যদি ও মধ্যযুগের বহু কাব্যে নাট্য ধর্মেীতা রয়েছে ।মানব জীবনের সুখ-দুখঃ আশা-আকাঙ্ক্ষাদি প্রকাশকারী এ শাখাটি লক্ষণ পাঁচালী, কথকতা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচার হয়েছে এবং এ নাটকের সৃষ্টিতে পেছনে পাশ্চত্য সাহিত্যের সুদূর প্রসারী প্রভাব লক্ষণীয়। ধরা হয়ে থাকে বাংলা ভাষায় প্রথম নাটক পাই আজ থেকে দু’শ বছর পূর্বে। যার ফলে আমরা বর্তমানে এসে নাটকের এমন  বিকশিত রূপ দেখি।

 

      নাটকের শুরু কিংবা উদ্ভবের মূলে প্রায় সব দেশেই ধর্মের প্রভাব বিদ্যমান। আমাদের উপমহাদেশে ও নাটকের উদ্ভব ধর্মের আশ্রয়ে। যেমন প্রায় সমস্ত সংস্কৃত নাটকের বিষয়বস্তু রামায়ণ, মহাভারত বা পুরাণের কাহিনী।বাঙালির নাট্য রস পিপাসা প্রথম পরিস্ফূট হয় পাঁঁচালি যাত্রাকে কেন্দ্র করে। তখন নাটক গণ্য হত  মানুষের বিনোদনের মাধ্যম রূপে।  আধুনিক বাংলা নাটকের উদ্ভব সম্পর্কে ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন:-

 “ উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজি পড়া এবং ইংরেজি অভিনয় দেখা তরুণ ছাত্রের দল  ইংরেজি কেতায় অভিনয়ে প্রস্তুত হয়ে বাংলা নাটকের সূচনা করে দিয়েছি”।১


 ১৭৫৩ সালে কলকাতায় প্রথম রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে ইংরেজরা। ১৭৯৫ সালে রুশ দেশীয় হেরেসিস লেবেডভ বেঙ্গল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে। এবংDisguise & Love is the best Doctor নামে  ইংরেজি নাটক অনুবাদ করেন।  এবং পন্ডিত লোকনাথ এতে সাহায়ক হন। রুশীয় লেখকের এই সাহসী উদ্যামের পর ধীরে ধীরে বাংলা নাটক বিকশিত হতে আরম্ভ করে। ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজের মাধ্যমে নাট্যসাহিত্য এদেশে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায়। ১৮৩১ সালে প্রসন্নকুমার ঠাকুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু থিয়েটার এর  মাধ্যমে  নাট্যশালার প্রসর বাড়ে।  তখন ইংরেজি অনুবাদ অভিনীত হত।কিন্তু অনুবাদ নাটক বাঙালির নাট্যপিপাসা চরিতার্থ করতে পারেনি।১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে নবীনচন্দ্র বসুর বাড়িতে  “বিদ্যাসুন্দর” নাটক অভিনীত হয়। নাটকটি যথার্থ আধুনিকনা হলেও সম্ভাবত এটিই অভিনীত প্রথম  বাংলা নাটক।


     আমাদের জানা উচিত ১৭৯৫ সালে বাংলা নাটকের সাক্ষাৎ পাওয়া গেলেও বাংলা ভাষার নানা শাখায় মঙ্গলকাব্য, লোকসংগীত, পালাগান, জারিগান, কবিগান, গম্ভীরা, ময়মনসিংহ গীতিকা প্রভৃতির মাঝে নাটকের বীজ সুপ্ত ছিল। বিশেষ করে নৃত্য ও গীত এ উপাদানদ্ধয় থেকেই আধুনিক বাংলা নাটকের উদ্ভব ঘটেছে।ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বাংলা নাটকে বাঙালি জীবন ও সমাজের চিত্র উঠে আসতে শুরু করে। বাংলা নাটকের পরিনত রূপ এসেছে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। এ পরিবর্তনকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে।:-

১। উন্মেষ পর্ব

২। বিকাশ পর্ব

৩। পরিণত পর্ব


       উন্মেষ পর্বের নাট্যকার হিসেবে আমরা পাই তারানাথ শিকদারে “ভদ্রার্জুন”(১৮৫২), হরচন্দ্র ঘোষের      “ভানুমতির চিত্তবিলাস” (১৮৫৩) কোরব বিয়োগ ইত্যাদি। ১৮৩৫ সালের অক্টোবর মাসে নবীনচন্দ্র বসু তার শ্যামবাজারের বাড়িতে একটি নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন।এই মঞ্চে বিদ্যাসুন্দর নাট্যাভিনয় হয়। এই  অভিনয়ে চমকপ্রদ অভিনবত্ব ছিল এই নাটকের বিভিন্ন দৃশ্য বাড়ির বিভিন্ন  অংশে অভিনীত হয়েছিল। দর্শকেরা অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থান পরিবর্তন করে অভিনয় দেখে ছিলেন।আর এই নাটকটির প্রথম স্ত্রীর ভূমিকায় স্ত্রীলোক অভিনয় করেছিল।১৮৫৭ সালের ২৩শে জানুয়ারি আশুতোষ দেবের বাড়িতে নন্দনকুমার রায়ের “শকুন্তলা” নাটকের অভিনয় হয়। এটিকে বলা হয় বাঙ্গালীদের দ্বারা বাংলা নাটকের প্রথম অভিনয়। এরপর, রামনারায়ণ তর্করত্ন নাট্যকার হিসেবে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী। তার এই খাতির দ্যোতক  “কুলীন কুলসর্বস্ব” মৌলিক সামাজিক নাটক। কারন এর প্রাণদান ও সমাজ ছবি অঙ্কনে তিনি যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তাতে সমগ্র জাতির কৌতুহলই তাকে জনপ্রিয়তা দান করে।রামনারায়ণের কুলীনকুল সর্বস্ব নাটক সম্পর্কে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন:- 

  “সমস্যা পিড়িত মানব জীবনের অন্তর্বেদনা প্রথম সাহিত্যের পেছনে মর্মকথা, হাসির অন্তরালে অশ্রুর আভাস রামনারায়ণের এ নাটকটি জীবনোচ্ছল করেছে।”২


        নাটকের বিকাশ পর্ব শুরু হয় মধূসুদন ও দীনবন্ধু এর আবির্ভাবে। মাইকেল মধূসুদন দত্তের সাহিত্য জীবন শুরু হয় নাটক দিয়ে । রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের বেলগাছিয়ার নাট্যশালায় রামনারায়ণের অনূদিত  “ রত্নাবলী’’ নাটকের  অভিনয় দেখতে বহু গণ্যমান্য অতিথি এসেছিলেন ।মধুসূদন দত্ত এই নাট্য অভিনয় দেখতে এসেছিলেন।মূলত এই নাটকের এর পর থেকে তার সাহিত্যে পথচলা শুরু।বেলগাছিয়া থিয়েটারে যুক্ত হয়ে পাশ্চত্য সাহিত্যের আদর্শে বাংলা নাটকে তিনি নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে বাংলা নাটকের নবনির্মাণ করেন।ফলে পূর্ব প্রথানুগ নাটক বা পূর্ব প্রভাব কাটিয়ে ভাবীকালের পথের সন্ধান দেন যা সার্থক তর সৃষ্টির পর্যায়ে উন্নিত হয়। তার প্রথম সার্থক নাটক “শর্মিষ্ঠা”(১৮৫৯) দ্বিতীয় “পদ্মাবতী”(১৮৬০)। এবং তার শ্রেষ্ঠ ও সার্থক ট্রাজেডি  “কৃষ্ণকুমারী”(১৮৬১)।


      মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমসাময়িক নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ (১৮৬০)শুধু নীলকরদের অত্যাচারের বাস্তব নগ্ন চিত্রই নয় বরং গণনাটকের সূতিকাগরও।তাঁর অন্যান্য নাটক গুলো হলো- নবীন তপস্বিনী(১৮৬৩),লীলাবতী(১৮৬৭),কমলে কামিনী(১৮৭৩)। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক নাটকের ধারা পরিবর্তন করে দেয় কেননা এর আগে নাটক ছিল মনরঞ্জনের বিষয় কিন্তু নীলদর্পণ হয়ে যায় প্রতিবাদের নাটক।


       পরিণত পর্বে নাট্যকার হিসেবে আবির্ভাব ঘটে গিরীশচন্দ্র ঘোষ, মীর মশাররফ হোসেন, জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুর, মনো মোহন বসু,ক্ষিরোদ প্রসাদ, অমৃতলাল বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শচীন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ।


    গিরিশচন্দ্র ঘোষের ঐতিহাসিক নাটক  “সিরাজউদ্দৌলা, মীর কাসিম, ছত্রপতি শিবাজী” এবং পৌরাণিক নাটক  “অকালবোধন, রাবণ বধ, সীতার বনবাস, সীতাহরণ, অভিমুন্য বদ, প্রফুল্ল,থরনিধি, বলিদান, মায়া বসন।মীর মশাররফ হোসেন রচিত “জমিদার দর্পণ”, জ্যোতীন্দ্রনাথের-“পূর বিক্রম, সরোজিনী ,অশ্রুমতি স্বপ্নময়ী”।


       দিজেন্দ্রলাল রায়  নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার শব্দ প্রয়োগ কুশলতা অনন্য  ও একক। সামাজিক ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে তিনি সফল নাট্যকার। তাঁর নাটকসমূহ  “রানাপ্রতাপ সিং, শাহজাহান, সোহরাব রুস্তম, নুরজাহান” ইত্যাদি। 


         বাংলা নাটকের অপ্রতিদ্বন্দ্বি মহানায়ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রূপক  ও সাংকেতিকতায় কাব্যে, গীত্যে, ট্রাজিডিতে, সামাজিকতায়, কৌতুকে তাঁর নাটক পেয়েছে বহুমাত্রিক রূপ বৈচিত্র্যময় অভিধা। তিনি সামাজিক,ঋতুনাট্য, নৃত্যনাট্য, গীতনাট্য, ট্রাজেডি ধর্মী কৌতুকরস প্রধান প্রভৃতি নাটক রচনা করে বাংলা নাট্য সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ।বাল্মীকি প্রতিভা, মায়ার খেলা তাঁর গীতিনাট্য। চিত্রাঙ্গদা, বিদায় অভিশাপ- কাব্যনাট্য। রাজা ও রানী, বিসর্জন, মালিনী- ঐতিহাসিক নাটক।সাংকেতিক ও রূপকধর্মী নাটক শারদোৎসব, রাজা, অচলায়তন,ডাকঘর ইত্যাদি।


আধুনিক বাংলা নাটক রচনায় বিশেষ অবদান রেখেছেন সলীল সেন, কিরণ মিত্র, ধনঞ্জয় বৈরাগী, বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত, বাদল সরকার প্রমুখ নাট্যজন।বাংলা নাটক বিষয় ও আঙ্গিক ক্রমশ আধুনিক থেকে আধুনিকতর হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর পূর্বকালে ঢাকা কেন্দ্রিক নাট্যকারদের হাতে। যাদের মধ্যে ইব্রাহিম খায়ের, কামাল পাশা, আনোয়ার অন্যতম। নুরুল মোমেনের রূপান্তর, নেমেসিস, নয়া খানদান, যদি এমন হতে। মুনীর চৌধুরীর রক্তাক্ত প্রান্তর, চিঠি, কবর। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বহিঃপীর, তরঙ্গভঙ্গ ,উজানে মৃত্যু ইত্যাদি ।বাংলা নাট্য সাহিত্যের আধুনিক রূপকার এছারা আরো অনেকই রয়েছে।


  বাংলা নাটকের উদ্ভব কাল থেকে এই পর্যন্ত ঢাকা কলকাতা কেন্দ্রিক নাট্যকারদের বিশেষ প্রযত্নে বাংলা নাটক বহু বিষয় ও বৈচিত্রে হয়েছে বিচিত্র এসেছে নব নব মাত্রা।



তথ্যসূত্র:-১,২

বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত- অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়।

Comments