ছোট গল্পের সার্থক রূপকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।

 প্রাচীনতম প্রাগৈতিহাসিক যুগেও মানুষ গল্প কাহিনী রচনা করত শুনত ।কিন্তু যাকে ছোট গল্প অর্থাৎ ইংরেজি ভাষায় Short Story বলে তার জন্ম সাহিত্যের আধুনিক যুগে । ছোট গল্প বাংলা সাহিত্যের নবিণতম শাখা । আধুনিক যুগের এক যুগান্তকারী সৃষ্টি। সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় দিন দিন পাঠক প্রিয়তা হারাচ্ছে কিন্তু সাহিত্যের এই নব্য সৃষ্টি পাঠক প্রিয়তার শীর্ষে ।প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে মধ্যযুগের মধ্য দিয়ে আধুনিক কালের আগ পর্যন্ত পৃথিবীর নানা ভাষায় নীতি, ধর্ম, রোমান্স, অদ্ভূত প্রকৃতির নানা বিষয় নিয়ে গল্প লেখা হয়েছে। আমাদের দেশেও  অনেক গল্প প্রচলিত আছে। কিন্তু ছোট গল্প বলতে একটা নতুন ধরণের শিল্পকে বোঝায়।

    ছোটগল্প শব্দটির সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ওতোপ্রেত ভাবে জড়িত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের জনক। আধুনিক যুগের এই শিল্প কর্মটি তাঁর হাত ধরেই সৃষ্টি হয়েছে এবং তাঁর হাত ধরেই  একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো পরিগ্রহণ করেছে। সমালোচকেরা মনে করেণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সচেতন ভাবে ছোট গল্প লিখতে প্রবৃ্ত্ত হন।কারণ তাঁর আগের লেখকরা গল্প লিখলেও তারা সচেতন ভাবে তা লিখেননি। তাদের রচনা গুলো গল্পের লক্ষণাক্রান্ত হলেও পুরাপুরি গল্প হয়ে ওঠেনি। ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন-

  রবীন্দ্রনাথই প্রথম সচেতন ভাবে ছোটগল্প লিখতে প্রবৃত্ত হন ,তিনিই এর পথনির্মতা আবার  এর শ্রেষ্ঠ শিল্পী।১

      ছোট গল্পের আকার আকৃতি ও গঠন প্রকৃতি ‍নিয়ে জল্পনা কল্পনার কোন শেষ নেই।কেউ কেউ মনে করে ছোট গল্প ফুলিয়ে ফাপিয়ে লিখলে উপন্যাস হয় এবং উপন্যসের ডালপালা ছেটে দিয়ে ছোট করে দিলে ছোটগল্প হয়। ছোটগল্প উপন্যাসের মতো সমগ্র মানব জীবন নিয়ে আলোচনা করে না এটা মূলত মানব জীবনের বিশেষ একটা দিক বা ঘটনা উপস্থাপন করে । ছোটগল্প আর পাঁচটা গল্পের মতো শুধু আখ্যান সর্বস্ব ব্যাপার নয়। সংহত পরিধিতে বাহুল্য বর্জিত ভাবে মানুষের জীবন সম্বন্ধে কোন একটি  কেন্দ্রী ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করাই ছোটগল্পের প্রধান লক্ষ্য।
    ছোটগল্পের প্রকৃতি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  “সোনার তরী” কাব্য গ্রন্থের “বর্ষাযাপন” কবিতার কিছু লাইন স্মরণীয়। কবিতার এই লাইন গুলোকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক ছোটগল্পের সজ্ঞা  হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। ছোটগল্পের প্রকৃতি এমন হওয়া উচিৎ যেন শেষ হয়েও হইল না শেষ।
বর্ষাযাপন কবিতার লাইন গুলো নিম্নরূপ:

ইচ্ছা করে অবিরাত আপনার মনোমত 
গল্প লিখি এককেটি করে ।
ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখ কথা 
নিতান্তই সহজ সরল
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি 
তারি দু-চারটি অশ্রু জল 
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে 
শেষ হয়েও হইল না শেষ
[বর্ষাযাপন, সোনার তরী]


 বাংলাদেশে গল্প-আখ্যান প্রচলিত থাকলে ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থ ছোটগল্পের জীবন দান করেন। তাঁর উপন্যাসের জনপ্রিয়তা যেমন হোক না কেন ,ছোটগল্পে তিনি বিশ্বের যে কোনো শ্রেষ্ঠ শিল্পীর সমকক্ষ।তাঁর ছোটগল্প লেখার যাত্রা শুরু হয়  “ভিখারিনী” গল্পের মধ্য দিয়ে এর পর রচনা করেন  “ঘাটের কথা ” ও  “রাজপথের কথা”। এই গল্পগুল পুরাপুরি গল্প হয়ে উঠতে পারেনি। মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের এই নববাহন সম্পর্কে মনস্থির করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প প্রতিভার পরিস্ফুটন ঘটে ছিলো “হিতবাদী” পত্রিকায়। এ কারনে ১৮৯১সালকে রবীন্দ্র ছোটগল্পের তথা বাংলা ছোটগল্পের সূচনা কাল বলা হয়।
        রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পগুল তাঁর গল্পগুচ্ছে তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।ছোটগল্প গুলোর শিল্পগুণ বিচারে যেমন উৎকৃষ্ট, তেমনি বাঙালির গ্রামিণ ও নাগরিক চিত্র হিসেবেও তার মূল্য অপরিসিম। তাঁর গল্পে মানব জীবনের জটিল রূপের চিত্রাঙ্কনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে ছিলেন তাঁর তর্কাতীত শিল্পী সামার্থ্য। জীবন যে জটিল রক্তাক্ত এবং স্ববিরোধী তা গল্প লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অজানা ছিল না।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটগল্পে এমন একটি আয়তন সংযোজন করে ছিলেন যার ফলে সাধারণ প্রেমের গল্প, অপরাধ ‍মিশ্রিত প্রেমের গল্পও পেয়েছে নতুন রূপ। শত বছর আগে রচিত এসব গল্পের বিন্যাস ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পাঠক, গবেষকদের মুগ্ধ করে।
    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্পে মানুষ প্রকৃতি এবং রহস্য-লোকের অতিপ্রাকৃত ভাবের বিশেষ প্রভাব দেখা যায়। আমাদের গ্রাম্য ও নাগরিক জীবনের নানা ছবি, একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনধরা দশা ,সামাজিক ও ব্যক্তিগত সংস্কারের সঙ্গে ছোট বড় নানা কাহিনী তিনি তাঁর ছোটগল্পে তুলে ধরেছেন ।শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কয়েকটি আশ্চার্য বুদ্ধিদীপ্ত গল্পে আধুনিক জীবনের সমস্যার অবতারণা করেছেন- যেমন :- রবিবার, শেষকথা ইত্যাদি।এতে আধুনিক জীবনের নানা ব্যক্তিগত বিষয়ের অবতারণা করে বৃদ্ধ কবি বর্তমান সমাজ সংস্কারের প্রতি সজিব কৌতূহলের পরিচয় দিয়েছেন।
    ছোটগল্পকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোপাঁসা, চেকভের পাশেই স্থান দেওয়া হয়।তাঁর গল্পে টলস্‌টয় সুলভ ধর্মীয় কোনো অনুশাসনের ইঙ্গিত নেই , নেই মোপাঁসার মতো মানুষকে দেহধারী সজীব জন্তু ভাবার ইঙ্গিত। তাঁর গল্প আধুনিক কালেও সকলের মনোযোগ আকরষণ করে। তার জন্য আধুনিক বাংলা ছোটগল্পে সারাভারতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠের গৌরব লাভ করেছেন। কারণ বাংলা ছোট গল্পকে বিশিষ্ট শিল্পমূর্তি রূপে প্রতিষ্ঠা তাঁর একক কৃতিত্ব বলে স্বীকৃত। তাই তাকে ছোটগল্পের সার্থক রূপকার তথা ছোট গল্পের জনক বলা হয়।

 তথ্যসূত্র:

১. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়; পৃষ্ঠা নং ৫০৭।

Comments