মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিহ্ন উপন্যাসের রাজনৈতিক সফলতা আলোচনা কর।

    ‘চিহ্ন’ (১৯৪৭) মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সফল রাজনৈতিক উপন্যাস। উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রশিদ আলী দিবস এর প্রেক্ষাপটকে উপজীব্য করেছেন। আজদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলেন রশিদ আলী ব্রিটিশ সরকারের সামরিক আদালত তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়। তার প্রতিবাদে ১৯৪৬ সালের ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় গণ-আন্দোলন হয় এবং অনেকেই নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। ঔপন্যাসিক এই উপন্যাসকে নতুন টেকনিকে লেখা বই বলেছেন। এই উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে অ-রাজনৈতিক বা সাধারণ চরিত্রগুলো কীভাবে সক্রিয় রাজনৈতিক চরিত্র হয়ে যায় এবং সুযোগ সন্ধানী নেতা ও ব্যবসায়ীরা দেশের মানুষ ও অচল অবস্থাকে পুঁজি করে যেভাবে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করতে নেমে যায়। এই উপন্যাসের ঘটনাকাল দুই দিনের। এই অল্প সময়ের মধ্যে ঔপন্যাসিক কলকাতা শহর থেকে মধুখালী গ্রামের রাজনৈতিক অবস্থা তুলে ধরেছেন।

   ‘চিহ্ন’ বসুমতী পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে এতে কিছু সংশোধন ও পরিবর্তন করেন। চিহ্ন উপন্যাসে Protagonist বা নায়ক চরিত্র হিসেবে একক কোন চরিত্র পাওয়া যায় না। তবে সকল চরিত্র রাজনৈতিক আন্দোলনের রাজপথকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছে। তাই বলা যায় চিহ্ন উপন্যাসে প্রভাব বিস্তারকারী চরিত্র এই রাজপথ, সে হিসেবে রাজপথকে এই উপন্যাসের Protagonist বলা যায়। রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে মানব চরিত্রগুলো সমান ভাবে সক্রিয়। চিহ্ন উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলো হলো হেমন্ত, সীতা, রসুল, রজত, নারায়ণ, ওসমান, অক্ষয়, অজয়, গণেশ, নেতা অমৃত মজুমদার এছাড়া কালোবাজরী নারী লোভী চরিত্র হিসেবে পাওয়া যায় এন দাশগুপ্ত ও তার সহযোগী চন্দ্র। উল্লেখিত চরিত্রগুলো রাজনৈতিক অবস্থার দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয়। ঔপন্যাসিক এই ক্ষুদ্র উপন্যাসটিতে তা দেখিয়েছেন।

 উপন্যাসের শুরুতেই ঔপন্যাসিক যেন গণেশের নির্ভয় নির্বিক চিত্তের কথা বলেছেন। শুরুর লাইনটি ছিল- “প্রাণ ধুকপুক করে না গণেশের।” গণেশ গ্রামের দারিদ্র যুবক জীবীকার সন্ধানে শহরে এসে দোকানে কাজ করে। একদিন সে পথসভা ও অবরোধের মধ্যে গিয়ে পরে। চাইলে সে আর দশজনের মতো নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারত। কিন্তু সে পালায়নি। এই স্বাধীনতাকামী জনতার ঢল তার গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা হলদি নদীর পূর্ণিমার কোটালের জোয়ার এর মতো। শহরের পথে সেই জোয়ার এসে থেমে গেছে যেন গতিহীন গর্জন, সাদা ফেনার বদলে কালো চুলের ঢেউ। গণেশের মাথার পিছনে গুলি লাগে কিন্তু তাতে তার কোন। ভ্রুক্ষেপ নেই, তার একটাই জানতে চাওয়া “এরা এগোবে না বাবু?” গণেশ যেন মৃত্যুকে আলিঙ্গনরত চোখ দিয়ে জনতার জয় দেখতে চায়। মৃত্যুপথযাত্রী গণেশও স্বাদ পেতে চায়। স্বাধীনতাকামীদের কাছে জীবনের চেয়ে স্বাধীনতা বড় তাই গণেশের প্রাণ ধুকপকু করেনি।

এই উপন্যাসে মায়ের অন্ধোস্নেহে বড় হওয়া ভালো ছেলে হেমন্ত। দরিদ্র গানের শিক্ষিকা অনুরূপা হেমন্তের সকল প্রকার কার্যক্রম গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং হেমন্ত ও তার মায়ের অনুমতি ছাড়া কোথাও যাওয়ার সাহস করত না। কলেজে যাওয়া আসা এবং কোথাও গেলে সন্ধ্যার পূর্বে বাড়ি ফেরা ছিলো যার সংবিধান। সেই হেমন্ত এক সময়ে মায়ের মতামত উপেক্ষা করে জড়িয়ে পরে রাজনৈতিক সভা সমাবেশে। হেমন্তর আত্মকেন্দ্রীক স্বভাবের জন্য তার বন্ধুরা তাকে ভালো ছেলে বলে উপহাস করত। হেমন্ত বলে- “এসো ভালো ছেলে বলে অভ্যর্থনা জানিয়ে ছিল সীতা। বলেছিল, ক্লাস হল না বলে কষ্ট হচ্ছে? মন খারাপ? কী কী করব বলো। সবাই তো বিদ্যালাভ করেই খুশি থাকতে পারে না, অন্যায়-টন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানাতে চায়।” সীতার এই কথা হেমন্তের মনুষত্বে রীতিমত ঘাঁ মেরেছিল তার ভিতরে মানুষত্ব বলতে কিছু আছে কিনা সেই প্রশ্ন জাগিয়ে ছিল। এরপর থেকেই হেমন্তর মধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করে।হেমন্ত এর আগে মনে করত নিয়মানুবর্তিতাকে চুলায় দিয়ে পড়ালোখা তাকে তুলে হইচই হাঙ্গামা নিয়ে মেতে থাকার জন্য রাজনীতি চর্চার চেয়ে ভালো ছুতা আর কী হতে পারে?

হেমন্ত মায়ের কাছে করা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে সমাবেশে বসে আছে। আর ভাবে এখানে এভাবে তাকে পুলিশের লাঠি ও গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে বসে থাকতে দেখলে তার মার মুখের ভাব কেমন হতো। হেমন্তের বাড়ি ফিরতে দেড়ি হওয়া, আহাত হয়ে হাসপাতালে যাওয়া এই যে তার মার নিয়মের বাহিরে চলে যাওয়া এর জন্য অনুরূপা সীতাকে দায়ী করেন। অনুরূপা মনে করে হেমন্ত সীতার সাথে বেশি উঠা বসা করে এই মেয়ের প্রেমে পড়ে এমন হয়েছে। অনুরূপার এই অভিযোগ যেন ঔপন্যাসিক নিজেই খণ্ডন করলেন:- “সীতা বলে আশ্চার্য ও আহাত হয়ে, ছেলেমানুষি ভুল করলেন একটা। আমার সঙ্গে মেশার জন্য আপনার ছেলে বদলায়নি। অত বড় গৌরব দাবি করার অধিকার আমার নেই। হেমন্ত নিজেই বদলেছে, স্বাভাবিক নিয়মে। দেশের এই অবস্থা, এটা বুঝতে পারেন না যে সব কিছুর মধ্যে এ দেশে রাজনীতি জড়িয়ে আছে, ছোঁয়াচ বাচিয়ে চলতে হলে তাকে তালা বন্ধ করে রাখা দরকার?”

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপন্যাসে ছোট ছোট বালক চরিত্র গুলোকেও রাজনৈতিক ও স্বাধীনতার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে সৃষ্টি করেছেন। হেমন্তের ছোট ভাই জয়ন্ত এবং রজত চরিত্র দুটি এমনই চরিত্র। পারিপার্সিক অবস্থা তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে এই দেশ তাদের ওরা কেন গুলি করবে। অনুরূপা হেমন্তকে যেভাবে বড় করেছে জয়ন্তকে ও সেভাবে বড় করতে চায় তাই কখনো চোখের আড়াল হতে দেয় না। কিন্তু জয়ন্ত ও আসে তার সমবয়সী শিশুদের নিয়ে মিছিলের মোড়ে। ন-বছরের শিশুর প্রশ্নই বুঝিয়ে দেয় রাজনৈতিক সচেতনতা মানুষের মধ্যে আপনে আপনে সৃষ্টি হয়। ন-বছরের শিশির জিজ্ঞেস করে- “কেন গাড়ি চলবে না ভাই?.....গুলি করবে কেন? এটা আমাদের দেশ, আমরা যা খুশি করব। ওরা গুলি করবে কেন?” তেরো বছরের বালক জয়ন্ত তার সমবয়সীদের নিয়ে সৈন্যবাহিনীর কমান্ডারের মতো শ্লোগান দিতে গিয়ে গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করে। তাদের শ্লোগান ছিল “ইনক্লাব জিন্দাবাদ। জয় হিন্দ। বন্দে মাতরাম। ইনক্লাব” এই শ্লোগান তারা রাজপথ থেকেই শিখেছে। এবং বুঝেছে এই শ্লোগানের মধ্যেই তাদের মুক্তি।

সময় এমন ভাবে মানুষের মননে গেথে গেছে যে মাত্র পনের-ষোল বছরের কিশোরটিও বয়স্ক অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবীর মতো কথা বলতে শুরু করে।এই উপন্যাসের এমনই একটি কিশোর চরিত্র হলো রজত। কিশোর রজত নারায়ণকে বলে প্রতিশোধ সবারই নিতে ইচ্ছে করে কিন্তু শুধু ইচ্ছে করলেই তো হয় না? যা ইচ্ছে তা করলে চলে না। মূলত শান্তিপূর্ণ আন্দোলকে শাসক শ্রেনি সব সময় চায় নাশকতার অযুহাতে দমন করতে । এই প্রেক্ষাপটে বজত বলে- “আমরা মারামারি করতে গেলেই তো ওদের মজা । তাই তো ওরা চায়। আমরা তো আর আমারা নই আর, এখন হলাম সারা দেশের লোক। …..ইচ্ছে করলে তো দু মিনিটে আমাদের তুলো ধুনো করে দিতে পারে, দিচ্ছে না কেন? আমরা যেই মারামারি করতে যাব ব্যাস, আমরা আর দেশের সবাই থাকব না শুধু আমরা হয়ে যাব। লোকে বলবে আমরা দাঙ্গা করে মরেছি।” এই কথার মধ্য দিয়ে বুঝা যায় ঔপন্যাসিকের কলমের কয়েকটা আচড়ে আঁকা রজত চরিত্রটি কতটা ধীশক্তি বিবেচনাবোধ সম্পন্ন চরিত্র। নারায়ণের মতো পাঠকও বিস্মিত হয়ে যায় রজতের রাজনৈতিক জ্ঞান দেখে।

 ‘চিহ্ন’ উপন্যাসের একটি সক্রিয় চরিত্র হলো রসুল। দুর্ভিক্ষের সময় রসুল কলেজের পড়া বন্ধ করে দিয়ে গ্রামে গিয়ে লঙ্গরখানা খোলে কিন্তু নোংরা ভিলেজ পলিটিক্স এর স্বীকার হয়ে আবার শহরে ফিরে আসতে হয় কিন্তু রসুলের স্বাধীনচেতা মনোভাব দমে যায়নি। এখানে এসেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়। রাসুলের মা আমিনা রাসুলকে দেখতে পান সকল আন্দোলনরত যুবকের মধ্যে। বলা যায় আমিনা যেন তার রসুলকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেছে।

অক্ষয় চাকরি নিয়ে বেশ ছিল কিছু কাল, যুদ্ধের বাজারে উপরি আয়ের উপায়টা খুঁজে পাওয়ার পর থেকে নিয়মিত মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে এবং স্ত্রী সুধাকে জঘন্য ভাবে প্রতিদিন অপমান করে। এটাই ছিল মাতাল অক্ষয়ের নিয়মিত কাজ। কিন্তু এই আন্দোলন দেখে আর তার মদ পান করতে ইচ্ছে হয় না। অক্ষয় চিন্তা করে গুলি খেয়ে মারা যাবে  জেনেও সাধারণ একটি ছেলে যদি এভাবে বসে থাকতে পারে সে নেশা যেন তার মদ পানের থেকে বড় নেশা। অক্ষয়কে যেন এই বড় নেশায় পেয়েছে। অক্ষয় বলে- “গুলি খেলে মরতে হবে জেনেও সাধারণ একটা ছেলে যে গুলি খাবার জন্য তৈরি,ওটা কীসের নেশা? মদ না খেয়েও যদি মানুষের ও রকম নেশা হতে পারে, আমি তবে কেন বোকার মতো গাঁটের পয়সা খরচ করে এই সস্তা বিশ্রী নেশা করি।” তরুণ ছাত্রদের শোভাযাত্রা আর অবস্থান ধর্মঘাট দেখে তার আত্মচেতনা জাগে। সে নিজেকে আর একবরা শুধরে নেবার চেষ্টা করে।

 ‘চিহ্ন’ উপন্যাসের সুযোগ সন্ধানী চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম চরিত্র হলো অমৃত মজুমদার নেতা বসন্ত রায়েরর্ ফেউ ও তার স্ত্রী অরুনা। বসন্ত রায়ের অনুপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ঘোলা জলে মাছ শিকার করার মতো নিজেকে বড় ‍নেতা প্রমাণ করার জন্য খুব  তৎপর হয়ে ওঠে। কিন্তু তার স্ত্রীর অকস্মিক মৃত্যুতে আর হয়ে ওঠে না।

এন দাশগুপ্ত প্রকাশ্যে বিদ্যুৎ লিমিটেড এর ব্যবসায় দেখালেও তলে তলে চলে অবৈধ মদের ব্যবসায়সহ বিভিন্ন অবৈধ কারবার। অমৃত বাবু এবং এন দাশগুপ্ত, রাজনৈতিক দুর্বল অবস্থার সুযোগ নিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে নেমে পরে।

  ‘চিহ্ন’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক অদ্ভূত আত্মচেতনা মূলক রাজনৈতিক উপন্যাস । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে সরাসরি  কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এই উপন্যাসকে রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে সফল হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চিহ্ন উপন্যাসের চরিত্র গুলোতে যে রাজনৈতিক জ্ঞান ঔপন্যাসিক দিয়েছেন তাতে চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্র। তা আমরা রজত চরিত্রে মধ্যদিয়েই দেখতে পাই। ঔপন্যাসিক মনে করেন রাজনৈতিক জ্ঞান জীবনের ঘাতপ্রতিঘাত থেকে জন্ম নেয়। নেতা শুধু তার প্রতিনিধিত্ব করে। চিহ্ন উপন্যাসের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে সকল চরিত্রগুলো আমরা দেখতে পাই তাদের মধ্যে ও অধিকার আদায়ের জাগারণ এসেছে। তাই তারা জীবন উৎসর্গ করতে ভয় পায় না। কলকাতা শহর থেকে প্রত্যান্ত গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পরেছে সামান্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন। তারই একখণ্ড ছবি তিনি একেছেন চিহ্ন উপন্যাসের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে।

Comments